Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

১৭৮১ সালে যশোর জেলায় বৃটিশ প্রশাসনের প্রতিষ্ঠা

১৭৮১ সালে যশোর জেলায় বৃটিশ প্রশাসনের প্রতিষ্ঠা
যশোর কোর্টের যাত্রা শুরু

১৭৮১ সালে এপ্রিল মাসে গভর্ণর জেনারেল বাংলায় দেওয়ানি আদালতের সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি করে। পূর্বে যা ছিল অর্ধেক ডজন, তা এবার সংখ্যায় হলো তার দ্বিগুণেরও বেশি। মুড়লীতে একটা নতুন আদালত স্থাপিত হলো যার জুরিসডিকশন বা ক্ষমতাধীন এলাকা ছিল পুরো যশোর ও ফরিদপুর এবং ইছামতি নদীর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত ২৪ পরগণাগুলো। মুড়লী ছিল এই জেলার (অথবা অংগরাজ্যের) সদর দপ্তর। কারণ এটা ছিল মুসলমান সরকারের সদর দফতর এবং ব্রিটিশদের সময়ও তাই রইল। চাঁচড়ার রাজবাড়ি থেকে কাছে হওয়ার কারণেই মুড়লীকে সেই নতুন আদালতের সদর দপ্তর হিসেবে মনোনীত করা হয়। ওই নব্য প্রতিষ্ঠিত আদালত বা সিভিল কোর্টকে সাধারণভাবে বলা হয় মুড়লী বা যশোর আদালত। মুড়লী থেকে আদালত স্থানান্তরের সময় আদালতের পূর্বের নামেরও পরিবর্তন এসেছিল।

ম্যাজিস্ট্রেটগণ 
যে সরকারি আদেশ বলে আদালত প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো, সেখানে আরও বলা হয়েছিলো যে এই কোর্টের বিচারকগণ, ফৌজদার ও থানাদারদের উপর যে ক্ষমতা অর্পিত ছিল তাও অনুশীলন করবেন এবং এভাবে সমগ্র বাংলা থেকে ফৌজদার ও থানাদার পদ বিলোপ করা হয়। ফৌজদারগণ পরিণত হয় পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে আর থানাদার পদটি রূপান্তরিত হয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদে। ফৌজদার ও থানাদারদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও তীব্র অত্যাচারের জঘন্য ঘটনাগুলো ছিল এই পদের বিলুপ্তির পেছনে মূল কারণ। একই সাথে জেলায় একজন ইংরেজ অফিসারের নিকট তাদের সকল ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা হয়েছিলো। পুলিশি কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য একজন বিচারকরাই ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। সে শুধুমাত্র একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে ফৌজদারের স্থলাভিষিক্ত হন এবং একই সাথে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে থানাদারকে মানে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তার অধীন করা হয়। 

ফৌজদারী ব্যবস্থা
জেলা ম্যাজিস্ট্রেসির আসল নামটি ‘‘ফৌজদারি’’ শব্দটি থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এই শব্দটি ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল জুরিসডিকশন বুঝাতে ব্যবহৃত হত। যদিও ফৌজদারী কোর্টের কর্মকান্ড বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়েছে। এখন এটা শুধুমাত্র বিচারিক কর্মকান্ডে সীমাবদ্ধ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যখন ১৭৮১ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তখন এটা ছিল শুধুমাত্র পুলিশের উপর কর্তৃত্বকারী প্রতিষ্ঠান। তখনকার দিনে ম্যাজিস্ট্রেটদের কর্তব্য ছিল শুধুমাত্র পুলিশদের পরিচালনা করা। সে শুধু অপরাধ আমলে নিতে পারতেন কিন্তু তা বিচারের ব্যাপারে তার কিছুই করণীয় ছিল না।

ফৌজদারগণ এদেশের পুরোপুরি শাসনভার হাতে নেয়ার কিছু বছর আগে থেকেই রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়টি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে আসে। বৃটিশ শাসন ব্যবস্থার ইতিহাসের দরজা খোলার সাথে সাথেই  তারা মুসলিম রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা নিয়মিতকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পুরাতন জমিদারদের কাছ থেকে যে একাউন্ট ব্যবস্থা হস্তান্তর করা হয় তার মাধ্যমে আমরা এর প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি। এই পুরাতন জমিদারগণ ছিলেন একটি কলহপূর্ণ গোষ্ঠী যারা স্বাধীনচেতা ও রাজস্ব সময়মত পরিশোধের ব্যাপারে একদম উদাসীন ছিলো। তারা একজন আরেকজনের সাথে লড়াই করতে এবং তাদের দূর্বল প্রতিবেশীদের দখল করে নিতে ভালবাসত। যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা রাজস্ব পরিশোধ করত এবং তাদের দেনা শোধ করত ততক্ষণ নবাবেরা প্রতিটি জেলায় ছোট শক্তিমত্তার মিলিটারি গভর্ণর নিয়োজিত রাখতেন। এই মিলিটারি কর্মকর্তাকে বলা হত ফৌজদার। ফৌজদার নবাবের পক্ষ হতে লক্ষ্য রাখতেন যেন জমিদাররা নিশ্চিন্তে তাদের রাজস্ব পরিশোধ করতে পারে এবং তারা নিরাপদ থাকে। নবাবের কাছ থেকে জমিদারদের দেশের মিলিটারি কর্তৃত্ব নেওয়ার ক্ষমতা ছিল যেখানে জমিদাররা ছিলেন নবাবের অনুকম্পা প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ। শুধু এই কাজের বাইরে সম্ভবত ফৌজদারগণ অন্য কোন বিষয়ে চিন্তা করতেন না।

যখন বৃটিশরা দেশের রাজস্ব ব্যবস্থা নিজেদের হাতে নিয়েছিলেন তখন ফৌজদারদের কর্মপরিধি মুসলমান শাসন আমলে প্রতিপালিত দায়িত্বাবলী থেকে আলাদা ধরণের ছিল। বৃটিশদের প্রশাসনিক চিন্তাধারা ছিল সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা নয় এবং সে কারণেই ফৌজদারগণ পরবর্তীতে হয়ে গেল পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাদের নিয়ে গঠিত হলো ওয়ারেন হেস্টিং কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সমগ্র পুলিশ ব্যবস্থার অংশবিশেষ এবং তাদের অধীনে সৃষ্টি হলো বিভিন্ন পদের; যেমন থানাদার অথবা কোন ছোট কর্তৃত্বাধীন এলাকার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মুসলিম শাসন আমলে যশোর অঞ্চলে দুটি ফৌজদার ছিল, একটি হলো ভূষণা এবং অন্যটি মির্জানগর। এই দুটো ফৌজদারই পরবর্তীতে যশোরের পুলিশ ব্যবস্থার সূত্রপাত করে। এটাই ছিল ১৭৮১ পূর্ব অর্থাৎ ইংরেজ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব সময়কার যশোর জেলার চালচিত্র।

দারোগা

আসামীদের ধরে বিচার কাজ পরিচালনা করতে পারতেন এমন আরেকজন অফিসার হলেন দারোগা এবং মুড়লীর কতৃত্বাধীন এলাকার দু’জন দারোগা ছিলেন। একজন ছিলেন যশোরে, আরেকজন ছিলেন ভূষণায়। দারোগা শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদের নাজিমের কর্তৃত্বাধীনে ছিলেন এবং সরকার তার ব্যাপারে একেবারে সজাগ ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ ছিল যেন তারা দারোগাদের উপর কোন কর্তৃত্ব না করে। অবশ্য নিজাম কখনোই তার বিচার ও শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা বৃটিশ সরকারের হাতে সমর্পণ করেন নি। বৃটিশ সরকারেরও দারোগাদের উপর কোন কর্তৃত্ব ছিল না যদিও তাদের ইচ্ছা ছিল ফৌজদারি বিচার প্রশাসনের খুঁটিনাটির সাথে ম্যাজিস্ট্রেটদের সম্পর্কযুক্ত রাখা। সে কারণেই বৃটিশ সরকার নাজিমের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছিলো যেন দারোগাকে নির্দেশ প্রদান করা হয় প্রতিমাসের বিচার কার্যক্রমে একটি প্রতিবেদন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রদান করতে।

মূলত দারোগার ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত কম। সে একজন অপরাধীকেও বিচার করার ক্ষমতাসম্পন্ন বিচারক ছিলেন না, প্রকৃতপক্ষে সে ছিল এমন একজন অফিসার যে নাজিমের (অথবা নাজিম এবিষয়ে দেখাশোনার জন্য যে কর্মকর্তাকে নিয়োগ প্রদান করত) কাছে মামলার বিষয়ে শুধু রিপোর্ট প্রদান করতেন। একদম ছোট মামলাগুলো সে অল্প সময়ের জন্য সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে জেল প্রদানের দ্বারা সমাধান করতে পারতেন কিন্তু সংখ্যার বিবেচনায় এই মামলাগুলো ছিল খুবই অল্প কারণ এর থেকে অনেক বেশি মামলার রিপোর্ট তাকে বিচারের জন্য নিজামতের কাছে প্রেরণ করতে হতো।

একমাত্র সরকারি চাকুরীজীবী হিসেবে দারোগার ভূমিকা
একটি জেলায় একমাত্র সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন দারোগা। জনপ্রশাসনে যার সবকিছু করার এখতিয়ার ছিলো। দারোগার দায়িত্ব ছিল জমিদারের নিকট হতে আটককৃত ডাকাত, লুটেরা এবং খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা করা। তিনি ফরিয়াদির কাছ থেকে সরাসরি অভিযোগ গ্রহণ করতে পারতেন। ছোট মামলা ছাড়া অন্যান্য বড় মামলা পরিচালনায় তার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল কারণ অন্য সকল মামলায় তাকে সরকারের কাছ থেকে প্রসেডিং গ্রহণ করতে হতো এবং ধৃত ব্যাক্তির জন্য দেয়া সরকারের রায় এক্ষেত্রে চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতো। তত্ত্বগত বা ব্যবহারিক কোনপ্রকারেই জমিদারদের উপর নজরদারির ক্ষমতা দারোগার ছিল না।

আর এই ব্যবস্থা পরিচালনায় সরকারের একমাত্র লক্ষ্যমাত্রা ছিল রাজস্ব অর্জন। যতক্ষণ জমিদার সরকারকে রাজস্ব প্রদান করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসনের সকল কার্যাবলী জমিদারের উপর ন্যস্ত ছিল। তিনি প্রশাসনকে যেভাবে ইচ্ছা পরিচালিত করতে পারতেন। জমিদার ছিলেন মাঠ প্রশাসনের সর্বময় কর্তা। সরকারের পক্ষ থকে নামেমাত্র পরিবীক্ষণ করা হত। আর প্রশাসনের এরুপ ব্যবস্থাপনার পরিণাম খুব সহজেই অনুমান করা যায়। স্যার জে.ওয়েস্টল্যান্ড ১৮৮১ সালে তার প্রতিবেদনে বলেছিলেন ‘‘এই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ও সবচেয়ে কর্মক্ষম ব্যক্তিও একজন প্রশাসক হিসেবে ব্যর্থতার পরিচয় দিবেন যদি তাকে কোন নিয়ন্ত্রণ বা পরিবীক্ষণ ছাড়াই এমন লোকদেরকে শাসন করতে পাঠানো হয় যাদের স্বার্থ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির (প্রশাসকের) স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। আর এই বিষয়টি আরো খারাপ হতে পারে যখন একজন কুখ্যাত শ্রেণী বৈষম্যকারী বাঙালি জমিদার নিজে ও তার দুর্নীতিপরায়ন অধীনস্তদের দিয়ে তার প্রজাদের উপরে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। সকল প্রকার ক্ষমতা নিজ হাতে কুক্ষগত রেখে দায়িত্ব পালন করতেন। পরবর্তী ১০০ বছরেরও জমিদারদের এই চরিত্রের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। আজও এই আলোকিত শতাব্দির দ্বারপ্রান্তে এসে তারা শুধু ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ন্যায়বিচারের দাবীকে বাতিল করে রাখতে চায়।’’ জমিদারগণ সরকারের নির্দেশাবলী অনুসরণ করতেন এবং প্রশাসনিক কার্যাবলী তার কর্তৃক বাছাইকৃত অধীনস্তদের উপর ন্যস্ত করতেন। এই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও সততা বিবেচনায় না এনে বরং মুনিবের স্বার্থ সংশি­ষ্ট কার্যাবলী প্রতিপালনে চতুর তৎপরতাকে বিবেচনায় আনা হত। সাধারণ প্রজারা শুধুমাত্র জমিদারদের খাজনা পরিশোধ করেই রক্ষা পেত না বরং জমিদারদের অধীনস্তদের অত্যাচারও সহ্য করতে হত। এভাবে তৎকালীন সমাজে প্রজা ও জমিদারদের মাঝামাঝি একদল ধনী সামন্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল। জমিদাররা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তার নিয়ন্ত্রণে থাকা চুক্তিভিত্তিক পুলিশ বাহিনীকেও নিকৃষ্টভাবে ব্যবহার করতেন। পুলিশের এমন নিস্পৃহ আচরণের কারণে ডাকাত ও লুটেরা অবাধে তাদের কাজ সাহসিকতার সাথে করতে পারত। তারা মাঝে মাঝে পুলিশের সাথে জোট বেঁধে, এমনকি জমিদার ও তার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে মিলিত হয়ে তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করত।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল অর্থহীন। এটা শুধুমাত্র জমিদার ও তার অধীনস্ত কর্মচারীর মর্জির বিষয় ছিল যে তারা অভিযোগ আমলে নেবেন কি নেবেন না। এক্ষেত্রে অভিযোগকারীর বাঁচার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। কারণ জমিদারের অধীনস্তরা প্রায়ই এইসব কুকর্মগুলি করত এবং অত্যাচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হত। তাই তাদের পক্ষে উক্ত অভিযোগকারীকে খুঁজে বের করে শাস্তি প্রদান করা কোন কঠিন বিষয় ছিল না।

জেল ব্যবস্থা

সমস্ত রেকর্ড ও জেলের দায়িত্বে থাকতেন একজন দারোগা। নাজিমের প্রদত্ত রায়ের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণের বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল। ম্যাজিস্ট্রেটরা বৃটিশ সরকারের কাছে আসামীদের প্রতি আচরণের বিষয়টি নিয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করেছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমেই দারোগা নায়েবে নাজিম কর্তৃক প্রদত্ত রায়ের ঘোষণাপত্রটি গ্রহণ করতেন। একটি ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেট সরকারের কাছে অভিযোগ করেছিলেন যে, ভূষণার দারোগা তার প্রেরিত একজন অফিসারকে রায় বাস্তবায়নের কার্যক্রমটি দেখতে দিতে অস্বীকার করেছিলেন। জেলের ক্ষেত্রেও দারোগা জেল মেরামতের সকল তালিকার পূর্বানুমতি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হতে গ্রহণ করতে বাধ্য থাকত নিজামের কাছে প্রেরণের পূর্বে। ১৭৮১ সালে স্থাপিত ফৌজদারী প্রশাসনের কাঠামোটা ছিল এমন। বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন একজন দারোগা আর নির্বাহী ক্ষমতা প্রতিপালন করতেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট যিনি ছিলেন একজন ইংরেজ অফিসার।